শিশিরকে কেউ মনে রাখে নাই

শিশু চিকিৎসক ডাঃ শিশিরকুমার বসুর খ্যাতি ছিল ভারতজোড়া। কলকাতা তথা ভারতের প্রথম শিশু হাসপাতাল গড়ে তোলার পিছনে ছিল তাঁর বিরাট অবদান। নেতাজির ভাইপো সুদীর্ঘ চিকিৎসক জীবন কাটিয়েছেন মানুষের সেবায়। আমরা কি তাঁকে সেভাবে মনে রেখেছি? প্রশ্ন তুললেন সায়ন মজুমদার।

ঘরের সেই পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে রাঙাকাকাবাবু মহম্মদ জিয়াসউদ্দিনের পোশাক পরে নিলেন, ওঁর বেডিংটা গুটিয়ে ঠিক করে নেওয়া হল। রাঙাকাকাবাবু ওঁর বাদামী রঙর গলাবন্ধ কোটের সঙ্গে ঢোলা পায়জামা পরলেন আর মাথায় কালো ফেজ টুপি। ছদ্মবেশের ব্যাপারে শেষ মুহূর্তে উনি একটা পরিবর্তন করলেন। বললেন, আমি যে কাবুলি চপ্পল জোড়া ওঁর জন্য কিনেছিলাম, সেটা পরে হাঁটা-চলা করা ওঁর পক্ষে কষ্টকর। তাই পুরোনো ফিতে বাঁধা মজবুত যে জুতো য়ুরোপে ব্যবহার করতেন তাই পরে নিলেন। তাইতে উনি বেশী আরাম পেলেন বটে, কিন্তু এই জুতো বিভ্রাটের ফলে আমাদের একটু বিপদে পড়তে হয়েছিল। যে চশমাটা উনি সে সময় পরতেন, সেটা ছেড়ে রেখে বছর দশেক আগের পুরোনো রোল্ডগোল্ডের ফ্রেমওয়ালা গোল কাচের চশমাটা সঙ্গে নিলেন....

...একেবারে সাইলেন্ট মার্চ করে আমরা পিছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়ির কাছে এসে পড়লাম। হোল্ড-অলটা সামনের সিটে রাখা হল। রাঙাকাকাবাবু নিঃশব্দে গাড়িতে উঠে দরজাটা বন্ধ না করে ধরে রইলেন, যদি কেউ জেগে থাকে তা দুটো দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ যেন শুনতে না পায়, তা হলে সন্দেহ হবে দুজন লোক বেরিয়ে গেল।

রাঙাকাকাবাবু গিয়ে গাড়িতে বসার পর আমি বেশ আওয়াজ করে চটি জুতো ফটফট করে গাড়িতে উঠলাম ও সশব্দে দরজাও বন্ধ করলাম। আমার এত সব চেষ্টাকৃত গোলমালে দূরে কোথায় কয়েকটা কাক ডেকে উঠল। বাইরের গেটটা অরবিন্দ এগিয়ে গিয়ে খুলে দিল, আমি যেন তুমুল গর্জন করে গাড়ি চালিয়ে জোরে বেরিয়ে গেলাম...

১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারির রাতে নিজের ‘রাঙাকাকাবাবু’ সুভাষচন্দ্র বসুকে কীভাবে পালাতে সাহায্য করেছিলেন ভাইপো শিশিরকুমার বসু, উপরের লেখাতে রয়েছে তারই বর্ণনা। শিশির বসু নেতাজির মহানিষ্ক্রমণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই তাঁর কথা উঠলেই এসে পড়ে নেতাজি প্রসঙ্গ। কোথাও গিয়ে দেশনায়ক হয়ে ওঠেন মুখ্য। আর শিশির হয়ে যান গৌণ। শিশু চিকিৎসক শিশির, বিপ্লবী শিশির, রাজনীতিক শিশির, মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থাকা শিশিরকুমার বসুকে নিয়ে আলোচনা তেমন আর কই? সেই শিশিরকে বাংলার কজনই বা চেনেন।